সত্যজিৎ রায় যখন মহানায়ককে চিনতেন তখন বাংলার জনপ্রিয় নায়ক উত্তম কুমার। মহানায়ক নন তখনও। সত্যজিতের সঙ্গে ‘নায়ক’ আর ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে কাজ করছিলেন উত্তম। প্রথম ছবিতে ‘নায়ক’ উত্তম কুমার আর তার আড়ালে থাকা ‘মানুষ’ উত্তম প্রকাশ্যে এসেছিল।
১৯৮০-র ২৪ জুলাই উত্তম কুমার চলে গেলেন। এর পরেই একত্রিত হয়েছিলেন অগষ্টে নিউ থিয়েটার্সে উত্তম স্মরণে, তাঁর সঙ্গে কাজ করা সমস্ত তারকা অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক। সেখানেই কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর সম্পর্কে নিজের অনুভূতি তুলে ধরেছিলেন।
কী বলেছিলেন তিনি তাঁর ‘নায়ক’-কে নিয়ে? ‘উত্তমকে যখন প্রথম পর্দায় দেখি তখনও আমি পরিচালনায় আসিনি। সেই সময় শুনেছিলাম, বাংলা ছবিতে নতুন নায়ক এসেছেন। শুনে তাঁকে দেখার আগ্রহ হয়েছিল। সেই দিনগুলোয় যে সব নায়কেরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, সায়গল, ধীরাজ ভট্টাচার্য জনপ্রিয়। যদিও তাঁরা সমতুল্য জনপ্রিয় ছিলেন না পাশ্চাত্যের নায়কদের।’
পরিচালকের দাবি, নিছক আগ্রহ থেকেই ‘আমি একটানা উত্তমের তিনটি ছবি দেখেছিলাম। তিনটিরই পরিচালক নির্মল দে। প্রথম দেখাতেই ভাল লেগেছিল তাঁকে। উত্তমের চেহারা সুন্দর। তাঁর উপস্থিতি যথেষ্ট আকর্ষণীয় এবং তাঁর অভিনয়ে মঞ্চাভিনয়ের কোনও ছাপ নেই। ফলে, আমি কিন্তু সেই সময়েই দেখতে পেয়েছিলাম ওঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যত।’
উত্তমের সঙ্গে সত্যজিতের কাজ করার সুযোগ অনেক পরে এসেছিল। তত দিনে উত্তম কুমার তারকা। প্রায় প্রতি বাংলা ছবিতে তিনিই নায়ক। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক হিট ছবি উপহার দিচ্ছেন দর্শকদের। পরিচালকের কথায়, ‘উত্তম তত দিনে হলিউডের ব্যাকরণ মেনে আক্ষরিক অর্থেই তারকা।’ তার পরেই তাঁর মোক্ষম প্রশ্ন, ‘একই সঙ্গে তিনি কি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন অভিনেতা?’
প্রশ্নের উত্তরও সত্যজিৎ নিজেই দিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি কিংবদন্তি হলিউড তারকা গ্রেগরি পেকের নাম নিয়েছিলেন। যাঁর অভিনয় প্রতিভা চাপা পড়ে গিয়েছিল ‘স্টারডম’-এর নীচে। পরিচালকের দাবি, ‘গ্রেগরি পেককে কেউ কোনও দিন ভুলবে না। তার পরেও বলব, তারকার খ্যাতি সামলাতে না পারলে এ ভাবেই খ্যাতির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।’ পাশাপাশি তিনি এও স্বীকার করেন, তারকাসুলভ হয়ে ওঠার পরেও উত্তমের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। যা গ্রেগরি পেক দেখাতে পারেননি। তাই ‘নায়ক’ পরিচালনার আগে পরিচালক এমন একটি দৃশ্যকল্প ভেবেছিলেন যার সঙ্গে মহানায়ক নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারবেন অনায়াসে।
উত্তমের জীবনের কিছুটা নিয়েই তিনি তৈরি করেছিলেন নায়ক। সত্যজিতের ভাবনা শুনে এক কথায় রাজি হয়েছিলেন উত্তম কুমার। কেবলমাত্র পরিচালককে ভরসা করে নায়কসুলভ সমস্ত আচরণ সরিয়ে স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন। সেই সময় সদ্য বসন্ত থেকে ভুগে উঠেছেন। মুখে বেশ দাগ। তার পরেও সত্যজিতের কথা মেনে তিনি এক ফোঁটাও মেক আপ করেননি। বাকিটা ইতিহাস। পরিচালক নিজে স্বীকার করেছেন, ‘খুব তাড়াতাড়ি চরিত্রে ঢুকে যেতে পারতেন। চরিত্র হয়ে উঠতেন। তার আগে খুঁটিনাটি আলোচনাও সেরে নিতেন। ছবিতে এমন অনেক দৃশ্য আছে যেটা মাথা খাটিয়ে বের করেছিলেন উত্তম। আমি অবাক হয়ে দেখতাম ওঁর সহজাত অভিনয় প্রতিভা।’